সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি | পরার্থপরতার অর্থনীতি | আকবর আলি খান

সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি : সংস্কারকে ব্যভিচারের সাথে তুলনা করে জনৈক রসিক ব্যক্তি বলেছেন: “যারা ব্যভিচার করে তারা কখনও এ সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না, যারা পারে না তারাই এ নিয়ে ফরফর করে। যারা সংস্কার করে তারাও এ সম্পর্কে বড়াই করে না, যারা সংস্কার করতে পারে না তারাই এ সম্পর্কে হইচই করে।” নৈতিক দিক থেকে অবশ্যই সংস্কার ও ব্যভিচারের মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। ব্যভিচার গর্হিত আর সংস্কার হল বাঞ্ছিত। তবু ব্যভিচার ও সংস্কার দুটোই হল সামাজিক দিক থেকে অত্যন্ত অপ্রিয়। এ ধরনের অপ্রিয় কাজ অতি দ্রুত সারতে হয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে করতে গেলেই বিপত্তি দেখা দেয়।

সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি - আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
সংস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, “পতিত অবস্থা হতে মুক্তি।” বিবর্তনের সাথে সাথে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয় না সেখানেই অধঃপতন দেখা দেয়। প্রখ্যাত দার্শনিক এডমুন্ড বার্ক যথার্থই বলেছেন, “A state without the means of some change is without its means of conservation” (যে রাষ্ট্রে কোন পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেই তার সংরক্ষণের কোন উপায় নেই।) যে কোন রাষ্ট্রকাঠামোতেই সময়ে সময়ে পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ সব পরিবর্তনের অনিবার্যতা অগ্রাহ্য করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।

[ সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি | পরার্থপরতার অর্থনীতি | আকবর আলি খান ]

পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতাকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ মনসুর অলসন (Mancur Olson) একটি সামাজিক ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এ রোগের তিনি নাম দিয়েছেন “institutional sclerosis” বা প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবন। কঠিনীভবন বা স্ক্লরৌসীস রোগে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কঠিন হওয়ার ফলে বিকল হয়ে যায়। তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবন হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থাতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড অচল হয়ে পড়ে। অলসনের ভাষায়, প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবনের চিহ্ন হল: “that slows its adoption to changing circumstances and technologies.” (যা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি ও প্রযুক্তির সাথে রাষ্ট্র কাঠামোর সমন্বয় বিলম্বিত করে।)

ব্যক্তির জীবনে সরৌসীস বিধাতার অভিশাপ, সমাজের ক্ষেত্রে “প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবন” মানুষের সৃষ্টি। তবে সংস্কার প্রবর্তনে নিছক অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা হতে “প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবনের” জন্ম হয় না। অনেক সময় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে দীর্ঘ সময় লাগে। আবার অনেক সময় সমস্যার প্রকৃত সমাধান নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা নতুন কোন ধারণা সহজে গ্রহণ করতে চায় না। একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ এ সন্দেহ সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন:

There are two areas where new ideas are terribly dangerous – economics and sex. By and large it’s all been tried, and if it’s new, it’s probably illegal or dangerous or unhealthy.

(দুটি ক্ষেত্রে নতুন ধারণা অত্যন্ত বিপজ্জনক – অর্থনীতি ও যৌন জীবন। মোটামুটি সবই করে দেখা হয়েছে। যদি ধারণাটি নতুন হয় তবে তা বেআইনি অথবা বিপজ্জনক অথবা অস্বাস্থ্যকর)।

তবে সংস্কারের সকল প্রস্তাবই অভিনব নয়। তাই অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে না। যারা জ্ঞানী তারা নিজেরা ভুল করার আগেই অন্যের ত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এমনকি যারা নির্বোধ তারাও নিজেদের ভুল হতেই জ্ঞান লাভ করে। বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রব্যবস্থাতে বিপর্যয় দেখা দেয় তখন সংস্কার প্রবর্তনে অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার কোন সুযোগ থাকে না।

প্রাতিষ্ঠানিক কঠিনীভবন ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করে কায়েমী স্বার্থবাদীরা। আধুনিক রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতা শাসকরাও নয়, জনগণও নয়। এ রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে বিশেষ স্বার্থের গোষ্ঠীসমূহ। অর্থনীতিবিদ অলসন এ সব গোষ্ঠীকে আখ্যায়িত করেছেন “বণ্টনমূলক জোট” (distributional coalition) । এদের উদ্দেশ্য সমাজের কল্যাণ নয়, আত্ম কল্যাণ; এরা উৎপাদন বাড়াতে চায় না, বণ্টন ব্যবস্থায় নিজেদের বখরা বড় করতে চায়।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
এ ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জোট, পেশাদারদের সমিতি এবং কর্মচারি ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন। যে কোন সংস্কার প্রবর্তিত হলেই কোন না কোন বণ্টনমূলক জোটের স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হয়। কোন গোষ্ঠীই তাদের স্বার্থের ব্যাপারে আদৌ কোন আপোষ করতে রাজি নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় লেনিনগ্রাডের রণক্ষেত্রে রুশ সৈন্যরা দেশমাতৃকার জন্য যে আবেগ ও ঐকান্তিকতা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল তার চেয়েও অনেক বেশি হিংস্রতা নিয়ে সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে কায়েমী স্বার্থবাদীরা।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে একদিকে রাষ্ট্রের কর্মপরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে, অন্য দিকে বণ্টনমূলক জোটের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারী কর্মকর্তাদের সমিতি থেকে বণিক সমিতি, পেশাদারী সংগঠন হতে শ্রমিক ইউনিয়ন—সর্বত্রই বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর কালো হাত থাবা বাড়িয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রের সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষমতা হয়েছে অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে সংস্কারের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। প্রথমত, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতে ঘটছে আমূল পরিবর্তন। স্নায়ুযুদ্ধে কোন বিজয়ী বা বিজিত নেই।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে শুধু তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাই তিরোহিত হয়নি, সাথে সাথে ধ্রুপদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও বাতিল হয়ে গেছে। পুঁজি নয়, জ্ঞানই হচ্ছে নতুন বিশ্বায়িত ব্যবস্থায় ক্ষমতার মাপকাঠি। এই নতুন ব্যবস্থায় পুরানো দিনের নীতিসমূহ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রচলিত অর্থ-ব্যবস্থাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের আর্থিক ঘাটতি অবশ্যই নতুন কোন ঘটনা নয়। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্যার জন হিকস যথার্থই লিখেছেন :

If there is one thing about kings … if there is one general thing about them which we seem to learn from history books it is that more often than not they were hard up.

(রাজাদের একটি প্রবণতা … ইতিহাস থেকে আমরা যদি একটিও শিক্ষা গ্রহণ করি তা হল রাজাদের সব সময়ে অর্থের টানাটানি ছিল)।

আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে আর্থিক সংকটের একটি বড় কারণ হল এই যে, সবাই কর হ্রাস করতে চায় কিন্তু কেউই খরচ কমাতে চায় না। এর ফলে ক্ষুদ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতিমালা সার্বিক আর্থিক নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। সরকারের বাজেট ঘাটতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করেছে।

তৃতীয়ত, গত দুই শতক ধরে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদ এ্যান্ ক্রুগার এ ধরনের ব্যর্থতাকে দু ভাগে বিভক্ত করেছেন : করার ত্রুটি (errors of commission) আর না করার ত্রুটি (errors of omission)। সরকারের অপচয় প্রথম ধরনের ত্রুটির প্রকৃষ্ট নজির। দ্বিতীয়ত, না করার ত্রুটির মধ্যে রয়েছে অদক্ষ পরিচালনার ফলে সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর অকার্যকরতা এবং সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনুপযোগী নীতি (যথা, অবাস্তব বিনিময় হার সুদের হার ইত্যাদি) অনুসরণ। সরকার শুধু যা করছে তা ভালভাবে করলেই চলবে না, যা করছে না তাও করতে হবে।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাই যথেষ্ট নয়। সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু ভাল অর্থনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাল রাজনীতি নয়। যে ধরনের সংস্কার ভোটারদের আকৃষ্ট করে না, সে ধরনের সংস্কার রাজনীতিবিদদেরও আশীর্বাদ লাভ করে না। রাজনীতিবিদদের পক্ষে সংস্কার সম্ভব নয়, সংস্কারের জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের। রাজনীতিবিদদের চিন্তা আগামী নির্বাচনে সীমাবদ্ধ, একমাত্র বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়করাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়ার মত অনিশ্চিত। সংস্কারের নিশ্চিত সাফল্যের কোন অব্যর্থ দাওয়াই নেই। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনাচার ও অব্যবস্থা রাতারাতি দূর করার কোন উপায় নেই। তাই সংস্কারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কদের স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে। যেখানে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস ও সংঘাত বেশি সেখানেই প্রয়োজন সৃজনশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
অর্থনীতিবিদ আর্নল্ড সি হারবারগার (Arnold C. Harberger) এ ধরনের নেতৃত্বকে “অর্থনৈতিক নীতিবীর” (economic policy heroes) বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই ধরনের বীরগণ তাঁদের বিশ্বাস, সংকল্প ও সাহসিকতায় উজ্জীবিত হন। এঁরা রাজনৈতিক আত্মহত্যাকে ভয় করেন না। এঁরা জানেন যে, সংস্কারের ক্ষেত্রে যারা বীজ বপন করে তারা সব সময়ে ফলভোগ করতে পারে না। কাজেই ফল ভোগ করা বড় কথা নয়, গাছ লাগানোই হল সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্ব। যুক্তিশীল লোকের পক্ষে এ ধরনের সংস্কারক হওয়া সম্ভব নয়, একমাত্র দুঃসাহসী লোকদের পক্ষেই সংস্কার করা সম্ভব। জর্জ বার্নাড শ ঠিকই বলেছেন:

The reasonable man adapts himself to the world, the unreasonable one persists in trying to adapt the world to all progress depends on unreasonable man.

(যুক্তিবাদী লোক নিজেকে বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় কিন্তু অযৌক্তিক লোক বিশ্বকে তার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। সকল প্রগতি অযৌক্তিক উপর নির্ভরশীল)

স্বাভাবিক পরিবেশে এ ধরনের নেতৃত্ব পাওয়া যায় না। সাধারণত বৈদেশিক আক্রমণ ও মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের পরই এ নেতৃত্বের উদ্ভব হয়।

অবশ্যই সনাতন আমলাতন্ত্রের পক্ষে সংস্কারের দেওয়া সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্রের কোথাও অর্থনৈতিক লুকিয়ে থাকলেও, সামগ্রিকভাবে আমলাতন্ত্র নিজেই প্রচলিত ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। এরাই করে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জীবনে অব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। এরা নিজেদের উদ্যোগে এ সব অব্যবস্থা দূর করতে চাইবে না। তবে শুধু আমলাতন্ত্রই সংস্কারের প্রধান প্রতিবন্ধক নয়। না কেউ আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু সংস্কার সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কার মুনাফা হবে কার লোকসান হবে নির্ণয় সম্ভব তাই সংস্কার সম্পর্কে সকলেরই মনে থাকে সন্দেহ।

যেখানেই লাভ ও ক্ষতির প্রশ্ন রয়েছে সেখানেই সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ধ্বংস করার সংগ্রাম ধরনের সংগ্রামে সময় এক পক্ষ পর্যুদস্ত করে, আবার কোথাও কোথাও দু’পক্ষের মধ্যে আপোষ হয়। কিন্তু পরস্পরবিরোধী স্বার্থের মধ্যে সংঘর্ষের ফয়সালা হওয়ার আগে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।

সংস্কার যত বিলম্বিত হয় সংস্কারের পরিধি হয় তত ব্যাপক। উন্নয়নশীল দেশসমূহে দেশসমূহে সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ নিম্নরূপ:

ক. সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে ভর্তুর্কিসহ ব্যয় হ্রাস ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি;

খ. সরকারের আয়তন হ্রাস এবং প্রশাসনিক সংস্কার;

গ. আর্থিক খাত সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংক ও অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা এবং স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এই সব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান;

ঘ. রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের বেসরকারীকরণ এবং পণ্য ও সেবার মূল্যের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া;

ঙ. বাণিজ্য উদারকরণ, অশুল্ক বাধা তুলে দেওয়া এবং শুল্কের হার হ্রাস করা;

চ. বেসরকারী খাত বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কার।

সংস্কারের কৌশল সম্পর্কে দু’ধরনের মতবাদ দেখা যায়। এক ঘরানার অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, সংস্কারের প্রকৃত সুফল পেতে হলে সকল ক্ষেত্রে সংস্কার একই সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ধরনের মতবাদ প্রচণ্ড আঘাত পন্থা (big bang approach) নামে পরিচিত। দ্বিতীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদরা পর্যায়ক্রমে সংস্কারের পক্ষে। এ ধরনের মতবাদকে ধীর পন্থা ( gradualism) রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
“প্রচণ্ড-আঘাত পন্থার” সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন ডেভিড লিপটন (David Lipton), জেফরি স্যাকস (Jeffrey Sachs), এন্ডারস এ্যাসল্যান্ড (Anders Aslund), এন্ড্রু বাৰ্গ (Andrew Berg) প্রমুখ। এঁরা বিশ্বাস করেন যে, বিচ্ছিন্ন সংস্কার কখনও ফলপ্রসূ হয় না। সকল ক্ষেত্রে সংস্কার একই সাথে শুরু করতে হবে এবং স্বল্পতম সময়ে সম্পূর্ণ করতে হবে। এঁরা মনে করেন যে, উপর থেকে অতর্কিতে ক্ষিপ্রতার সাথে সংস্কার চাপিয়ে দিতে হবে। অর্থনীতিবিদ জোয়ন রবিনসনের মত এঁরাও বিশ্বাস করেন যে, অর্থনীতির প্রথম সবক হল, অর্থনীতিতে সব কিছুই অন্য সবকিছুর উপর নির্ভর করে। এঁরা বিশ্বাস করেন যে, এক খাতের সংস্কার অন্য খাতের সংস্কারের পরিপূরক। তাই অর্থনীতির এক খাতের সাফল্য অন্য খাতকে উজ্জীবিত করে এবং এক খাতের ব্যর্থতা অন্য খাতে সংক্রমিত হয়। এই ঘরানার অর্থনীতিবিদদের দ্বিতীয় যুক্তি হল, সংস্কারের সাফল্যের একটি আবশ্যিক শর্ত এই যে, জনগণকে সরকারের সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সম্পর্কে আস্থাশীল হতে হবে। যদি এ ধরনের ধারণা জন্মে যে, গৃহীত সংস্কারসমূহ পরিত্যক্ত হতে পারে তবে কেউই সংস্কারকে সমর্থন করতে চাইবে না। শুধুমাত্র ব্যাপক ও দ্রুত সংস্কারই জনমনে আস্থা সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, এ মতবাদের মনে করেন যে, সংস্কার প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে সংস্কারের শত্রুরা ততই মরিয়া হয়ে সংস্কার প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। একমাত্র প্রচণ্ড আঘাতের মাধ্যমেই সংস্কারের বিপক্ষে রাজনৈতিক বিরোধিতা নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব।

প্রচণ্ড-আঘাতপন্থীদের বক্তব্য পড়লে মোল্লা নরুদ্দীনের একটি গল্প মনে পড়ে যায়। মোল্লা নসরুদ্দীন এক বাড়িতে কিছুদিন চাকরের কাজ করেছিলেন। মনিব তাঁকে একদিন ডেকে বললেন,

দেখ বাপু তুমি একবারের কাজ একবারে কর না। তোমাকে তিনটি ডিম আনতে বললে তিন বার বাজারে যাও। এতে অযথা সময় নষ্ট হয়। এবার থেকে একবারে সব কাজ সেরে আসবে।

একদিন মনিবের অসুখ করলো। তিনি নরুদ্দীনকে ডেকে বললেন, “হেকিম ডাক নসরুদ্দীন গেলেন, কিন্তু ফিরলেন অনেক রাতে। আর সঙ্গে নিয়ে আসলেন এক দঙ্গল লোক। মনিব ক্ষেপে বললেন,

“হেকিম কই? এত সময় লাগল কেন?”

নসরুদ্দীন বললেন,

“আপনি যেভাবে হুকুম করেছেন সেভাবেই কাজ করেছি। হেকিম নিয়ে এসেছি। কিন্তু হেকিম যদি আপনার অসুখ দেখে বলেন পুলটিস লাগবে, তার জন্য লোক নিয়ে এসেছি। হেকিম যদি বলেন গরম জল চাই, তবে কয়লা লাগবে। তাই কয়লাওয়ালা নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে যদি আপনার শ্বাস ওঠে তবে কোরান শরীফ পড়ার জন্য মৌলভী লাগবে। তাই মৌলভী সাহেবকে নিয়ে এসেছি। আর আপনি যদি মরে যান তবে লাশ বইবার লোক চাই। সে জন্যও লোক নিয়ে এসেছি।”

মোল্লা নরুদ্দীনের কপাল ভাল এতসব লোক জোগাড় করে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁর মনিব জীবিত ছিলেন। কিন্তু এত সব সম্পন্ন করার বহু আগেই বেশির ভাগ রোগী মরে যাবে। একসাথে এত সংস্কার করতে গেলে আঁতুড়ঘরেই সংস্কার অক্কা পাবে।

চায় ধীর পন্থার সমর্থকগণ মনে করেন যে, সংস্কার উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ মতবাদের সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন রিচার্ড পোর্টেস” (Richard Portes), রোনাল্ড ম্যাকিনন” (Ronald Mckinnon), ম্যাথিয়াস ডিউয়াট্রিপন্ট (Mathias Dewatripont) এবং রোনাল্ড জেরার্ড (Ronald Gerard) তাঁরা মনে করেন যে, সংস্কার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রচণ্ড আঘাত জনগণের কষ্ট বাড়ায় এবং জনগণকে সংস্কার প্রক্রিয়া হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

ধীরপন্থীরা মনে করে যে, আস্তে আস্তে সংস্কার বাস্তবায়নে জনগণের যন্ত্রণা লাঘব হবে এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার পক্ষে ধীরে ধীরে জনসমর্থন সৃষ্টি হবে। ধীর পন্থায় সংস্কারের সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতার ফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শূন্য নয়, ঋণাত্মক। ব্যর্থ সংস্কার উপকারী নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপকারী। এ সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে:

Failed reform attempts could be very costly. For example, money spent to restructure state enterprises and pay off their debts is wasted if the enterprises fail to rove. More difficult to quantify, but not less important are the costs in wasted human and political capital.

(ব্যর্থ সংস্কার প্রচেষ্টা অত্যন্ত ক্ষতিসাধক। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যদি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে কোন উন্নতি না দেখা দেয় তবে এ প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্গঠন ও মন্দ দেনা পরিশোধের জন্য ব্যয়িত অর্থের অপচয় হয়। মানবিক ও রাজনৈতিক পুঁজির ক্ষতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়)।

ধীর পন্থার সমালোচকগণ মনে করেন যে, কায়েমী স্বার্থের বিরোধিতার ফলে সংস্কারের পক্ষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনসমর্থন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ধীর পন্থার সংস্কার প্রক্রিয়াকে তাই মোল্লা নরুদ্দীনের ভালুক শিকারের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। কথিত আছে যে, সুলতান একবার মোল্লা নরুদ্দীনকে তাঁর সাথে ভালুক শিকারে যাওয়ার জন্য তলব করলেন। নরুদ্দীন ছিলেন খুবই ভীরু। তবু সুলতানের আদেশ পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ভালুক শিকারে গেলেন। পরদিন নসরুদ্দীন খুবই খোশ মেজাজে বাড়ি ফিরে এলেন। মোল্লার স্ত্রী জানতে চাইলেন, ভালুক শিকার কেমন হয়েছিল। মোল্লা জবাব দিলেন, “চমৎকার”। মোল্লার স্ত্রী প্রশ্ন করলেন, “কয়টি ভালুক মেরেছেন?” মোল্লা বললেন, “একটিও না।”

আবার প্রশ্ন হল, “কয়টি ভালুক দেখেছেন?” মোল্লা উত্তর দিলেনঃ “একটিও না।”

মোল্লার স্ত্রী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “শিকার তা হলে চমৎকার হল কিভাবে?” মোল্লা বললেন, “আহা, বেগম। তুমি বুঝতে পারছো না। ভালুক শিকারে ‘একটিও না’ যথেষ্টের চেয়ে বেশি।” ভীরুরা ভালুক শিকার করতে পারে না; তাদের পক্ষে সংস্কার করাও সম্ভব নয়।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আসলে প্রচণ্ড আঘাতপন্থী ও ধীরপন্থীদের বিতর্ক বিভ্রান্তিমূলক। কোথাও সকল সংস্কার এক সাথে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে এক পর্যায়ের সংস্কার সম্পন্ন না হলে পরবর্তী পর্যায়ের সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সংস্কার সব ক্ষেত্রে রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সংস্কার করতে সময় লাগবেই। পক্ষান্তরে ধীর পন্থার লক্ষ্য সংস্কারের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করে রাখা নয়। প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে যথাসময়ে সংস্কার না করলে সংস্কারের সুফল কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কারের মূল সমস্যা হল কোন সংস্কার আগে বাস্তবায়ন করা হবে এবং কোন সংস্কার পরে বাস্তবায়ন করা হবে তার পরম্পরা (sequence) নির্ণয় করা।১৫ পরম্পরা নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে দুটো মতবাদ দেখা যায়।

একটি মতবাদের বক্তব্য হল সহজ সংস্কার হতে শুরু করে দুরূহ সংস্কার করতে হবে। এ মতবাদ কৌশলগত ছিট-মহল (strategic enclave) পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত। দ্বিতীয় মতবাদের বক্তব্য হল এই যে, যে খাতে সংস্কার করলে বেশি লাভ হবে সে খাতেই সংস্কার শুরু করতে হবে। বাস্তবায়নের সুবিধা বড় কথা নয় অর্থনৈতিক গুরুত্বই হবে সংস্কারের খাত নির্বাচনের মাপকাঠি। এ মতবাদ সম্ভবশ্রেষ্ঠ পরম্পরাভিত্তিক (optimum sequencing) পদ্ধতি নামে পরিচিত।

কৌশলগত ছিট-মহল পদ্ধতিতে সংস্কারের বক্তব্য হল এই যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এ ধরনের প্রশাসনের পক্ষে সব এলাকায় এক সাথে সংস্কার সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তাই যেখানে বাস্তবায়ন সহজ সেখানেই সংস্কার শুরু করতে হবে। এ কৌশলের দুটো সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, নির্বাচিত এলাকাতে সংস্কার শুরু করলে সংস্কারের সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সংস্কারে সাফল্য আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং ভবিষ্যতে সংস্কারের পথ সুগম করে।

দ্বিতীয়ত, কৌশলগত ছিটমহলে সংস্কার শুরু করলে সংস্কার বাস্তবায়নে যে সব ত্রুটি দেখা যায় তা দূর করা সহজ হয়। এক সাথে বেশি ভুল করলে শুধরানো সহজ হয় না। এই পন্থার দুর্বলতা দুটো। প্রথমত, এ পন্থা অনুসারে সংস্কার বাস্তবায়ন যে সব এলাকাতে সহজ সে সব এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে প্রথম প্রজন্মের সংস্কারের পর দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কারের জন্য আদৌ কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় না। সংস্কার শুধু কৌশলগত ছিট-মহলে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, সংস্কারকে সমগ্র ভূখণ্ডে ছড়িয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে যে সব সংস্কার প্রয়োজন সে সব সংস্কার আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু মাত্র রাজনৈতিক সুবিধার কথা চিন্তা করে সংস্কারের কৌশল নির্ধারণ করা সঠিক হবে না।

সম্ভবশ্রেষ্ঠ পরম্পরা-ভিত্তিক সংস্কারের সমর্থক হল অর্থনীতিবিদরা। এই কৌশলের মূল বক্তব্য হল, বিভিন্ন খাতের সংস্কার পরিপূরক। অর্থনৈতিক দিক থেকে আগে যে সব খাতে সংস্কার প্রয়োজন সে সব খাতে সংস্কার শুরু করতে হবে। এ মতবাদের প্রবক্তারা মনে করেন যে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের আগে অর্থনীতির উদারকরণ সঠিক হবে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বাজেট ঘাটতি হ্রাস করার আগে বাণিজ্য উদারকরণ করা হলে শুল্ক খাতে রাজস্ব কমে যেতে পারে।

এর ফলে বাজেট ঘাটতি আরো বাড়তে পারে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের আগে সুদের হারের উপর সকল বিধিনিষেধ তুলে দিলে সরকারের ঋণ বাবদ সুদের ব্যয় বেড়ে যাবে। এর ফলে বাজেট ঘাটতির সমস্যা প্রকট হবে। সম্ভবশ্রেষ্ঠ পরম্পরা-ভিত্তিক সংস্কারের সমর্থকগণ সংস্কারের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ অনুক্রম সমর্থন করেন সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, অভ্যন্তরীণ আর্থিক খাত সংস্কার, শ্রম বাজারসহ বিভিন্ন উৎপাদনের উপাদানের বাজার সংস্কার, পণ্যের বাজার সংস্কার, বৈদেশিক বাণিজ্যের সংস্কার এবং পুঁজি বাজার সংস্কার। অবশ্য সকল দেশের বাস্তব পরিস্থিতি অভিন্ন নয়।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
কাজেই প্রতিটি দেশকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে সংস্কারের সম্ভবশ্রেষ্ঠ পরম্পরা নির্ধারণ করতে হবে। প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি যথার্থই বলেছেন :

The innovator makes enemies of all those who prospered under the old order and only lukewarm support is forthcoming from them who would prosper under the new.

(যারা পুরানো ব্যবস্থাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তারা নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তকদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি যারা নতুন ব্যবস্থায় লাভবান হবে তারাও সংস্কারকে অত্যন্ত হালকা সমর্থন প্রদান করে)।

সংস্কারের শত্রুর অভাব নেই, কিন্তু সংস্কারের বন্ধু খুবই কম। এর দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, সংস্কারের ফলাফল নিশ্চিত নয়। তাই সংস্কারের ফলে যাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তারাও সরাসরি লাভবান না হওয়া পর্যন্ত সংস্কার সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রথম পর্যায়ে কারো লাভ হয় না বরং সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই অনেক অর্থনীতিবিদ বলে থাকেন যে, সংস্কারের ফল ইংরাজি J অক্ষরের মত।

প্রথম দিকে J অক্ষর নীচের দিকে নামে। সংস্কারের ফল প্রথম দিকে তাই ঋণাত্মক থাকে। J অক্ষর অল্প ব্যবধানে উপরের দিকে উঠতে থাকে। অতি অল্প সময়ের জন্য ঋণাত্মক প্রভাবের পর সংস্কারে সুফল দেখা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারের ফলাফল ঋণাত্মক থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কারের জন্য সমর্থন লাভ সম্ভব হয় না।

সংস্কার বাস্তবায়নে যে সব বাধা আসে তাদের সম্বন্ধে দু’ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষতিপূরণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অতি সহজে প্রদান করা সম্ভব। স্বল্প মেয়াদে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ ব্যয়বহুল হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর সুফল অনেক বেশি লাভজনক হতে পারে। কিন্তু ক্ষতির খেসারত তাদেরই দেওয়া সম্ভব যাদের ক্ষতি প্রত্যক্ষ ও আইনসঙ্গত। কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি প্রতিরোধ আসে তাদের কাছ থেকে যারা প্রচলিত ব্যবস্থা হতে অনুপার্জিত মুনাফা অর্জন করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিলেই তারা সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু শ্রমিকদের নামে যে সব ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বেআইনীভাবে অর্থ আত্মসাৎ করছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া শক্ত। তাই অনুপার্জিত মুনাফাখোরদের না তাড়িয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করা যাবে না। সংস্কারকে জয়যুক্ত করতে হলে কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। সংস্কারের পক্ষে সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে।

আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
আকবর আলি খান [ Akbar Ali Khan ]
কোন ধরনের সরকার সংস্কারের পক্ষে অধিকতর উপযোগী সে সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, একনায়কদের পক্ষে সংস্কার ত্বরান্বিত করা সহজ; কেননা একনায়কদের ভোটারদের খুশি করার কোন বালাই নেই এবং তাদের পক্ষে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করা সম্ভব। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে কায়েমী স্বার্থবাদীরা সংস্কারের বিপক্ষে অতি সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবু একনায়করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্কারের সপক্ষের শক্তি নন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, স্বৈরাচারী সরকার অনেক ক্ষেত্রেই দস্যু-সরকারে পরিণত হয়।

হাইতিতে ডুভালিয়র, উগান্ডাতে ইদি আমিন ও জায়ারে মবুতু সরকার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গণতান্ত্রিক সরকারও (যেমন স্পেনে) সাফল্যের সাথে সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে। বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন, ১৯৯৭-এর বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, এ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। শতকরা বিশ ভাগ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংস্কারের সহায়তা করেছে, অন্যদিকে শতকরা বিশ ভাগ ক্ষেত্রে একনায়কত্ব সাফল্যের সাথে সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে।

বাকি ষাট ভাগ ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে সকল ক্ষেত্রে সংস্কার সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে দস্যু সরকার কখনও টিকে থাকতে পারবে না।

সংস্কার হল এক ধরনের যুদ্ধ। সকল যুদ্ধেই রণনায়কদের মনে রাখতে হয় শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনাই যথেষ্ট নয়, সব সময়েই পেছনে হটে যাওয়ার জন্য আপৎকালীন পরিকল্পনা থাকতে হবে। সংস্কারকে শুধু সাফল্যের জন্য প্রস্তুত থাকলেই চলবে না, ব্যর্থতার জন্যও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সংস্কার হল প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের মত জটিল। প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক কোন আহাম্মকও শুরু করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের সম্পর্কের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি টানতে পারে একমাত্র পাকা খেলোয়াড়রাই। সংস্কারও যে কোন আহাম্মক শুরু করতে পারে কিন্তু সবাই সংস্কার শেষ করতে পারে না। যারা সংস্কার করে তারা বাঘের পিঠে চড়ে বসে। যারা সংস্কার শেষ করতে পারে না, তাদের অবস্থা নীচের ছড়ার নায়িকার হয়ে দাঁড়াবে:

There was young lady Niger

Who smiles she rode on tiger

They returned from the ride

With the lady inside And the smile the face of tiger.

(নাইজারের একজন যুবতী মহিলা একটি বাঘের পিঠে চড়ে হাসছিল। যখন ভ্রমণ শেষে তারা ফিরল তখন মহিলাটি ভেতরে আর হাসি বাঘের মুখে)।

সংস্কার করতে গেলে বাঘের পিঠে চড়তেই হবে। উন্নয়নশীল দেশসমূহ গহন অরণ্যের চেয়েও অনেক বেশি শ্বাপদ সঙ্কুল। এখানে কায়েমী স্বার্থবাদী বণ্টনমূলক জোটসমূহ (যারা ট্রেড ইউনিয়ন বিভিন্ন সমিতি নামে পরিচিত) বনের বাঘের চেয়েও হিংস্র ক্ষিপ্র। বাঘকে এড়ানোর স্বাধীনতা সংস্কারকের নেই। তবে সব বাঘের বিরুদ্ধে এক সাথে লড়াইয়ের প্রয়োজনও তার নেই। তার পক্ষে বাঘ নির্বাচন সম্ভব। প্রথম লড়াইয়ের জন্য সংস্কারককে তাই এমন বাঘ বেছে নিতে হবে যাকে সে সাফল্যের সাথে সম্পূর্ণ পরাভূত করতে পারবে। পারস্যের কাহিনীকার নতুন বিবাহিত স্বামীদের যে পরামর্শ দিয়েছে সংস্কারকদের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য: “গুরবা কুতান শব ই-আউওয়াল” (বিড়াল মারো প্রথম রাতে)।

তথ্যসূত্র:

১. Burke, Edmund, Reflections on the Revolution in France (New York: Doubleday & Co. Inc., 1961), p. 33

২. and Decline of Nations (New Haven: Yale University Press, 1982)

৩. প্রাগুক্ত, 58

8. Hicks, Sir Economic History (London: Oxford University Press, 1969), 81

৫. Krueger, Anne O.. “Government The Journal Economic Perspectives, 1990. 4. 25-40

৬. Harberger, Arnold “Secrets Success: A Handful of American Economic Review, 1993. vol. No. pp. 343-350

৭. উদ্ধূত Partington, Angela, ed., The Concise Oxford Dictionary of (Oxford: Oxford University Press, 1997), 302

৮. Lipton, and Sachs, Jeffrey, “Creating Market Eastern Europe: Case Poland”, Brookings Papers on Economic Activity, 1990 (1), 75-137

৯. Anders, Aslund, “Principles Systematic Change and Stabilization in Eastern Europe (Dartmouth Aldershot, 1991), pp 17-31

১০. Berg, Andrew and Jeffrey, International Trade Eastern Europe: The Case of Poland”, Economic Policy, 1992, 117-73

১১. Portes, Richard, “The Path An Introduction, European Economy, 1991, special issue, pp. 3-15

১২. Mckinnon, The Order Economic Liberalization (Baltimore: Johns Hopkins University Press, 1999)

১৩. Dewatripont, Mathias Ronald, G., of Packages Under Uncertainty”, American Economic Review, 1995, vol. 85. pp. 1207-1223

১৪. World Bank, Bureaucrats in Business (New York: Oxford University Press, 1955), p 16

১৫. World Bank, World Development Report, 1997 (New York: Oxford University Press, 1997), pp. 151-154

১৬. Machiavelli Niccolo, The Prince, Ball, George, tr., (London: Penguin Books, 1991)

১৭. World Bank (1997), প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা 144-150

আরও পড়ুন:

Leave a Comment